• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮
বদরগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে বাংলা স্কুল

শিক্ষিকা দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। শিশু শিক্ষার্থীরাও তা গ্রহন করঝে আনন্দের সঙ্গে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

বদরগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে বাংলা স্কুল

  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০১৮

আশরাফুজ্জামান বাবু, বদরগঞ্জ (রংপুর)

রংপুরের বদরগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ‘বাংলা স্কুল’। একজন টগবগে যুবকের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ওই স্কুলে বর্তমানে বিনা বেতনে ৯২ শিশু সানন্দে পাঠ গ্রহণ করছে। খুবই সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে পাঁচ শিক্ষক পরম স্নেহে পাঠদান করছেন শিশুদের। নিয়মিত পাঠ্যসূচির বাইরেও রয়েছে আইটি ক্লাস ও নির্মল বিনোদন চর্চা। ওই স্কুলের শিশুরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে জাতীয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবস। চলে অ্যাসেম্বলি, গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। স্কুলটি সরকারিভাবে পাঠ্যবই ছাড়া আর কোনো সাহায্য পায় না বলে জানা গেছে। উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের নিভৃত এলাকা শেখপাড়ায় ওই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফুলের বাগানবেষ্টিত নির্মল ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশে স্কুলের অফিস ও চারটি শ্রেণিকক্ষ। বাঁশ দিয়ে বানানো অর্ধেক বেড়া আর বাকি অর্ধেক টিন দিয়ে ঘেরা। ওপরে টিন শেড। অফিস ও তিনটি শ্রেণিকক্ষের মেঝে কাঁচা, অপরটির মেঝে পাকা। তবে কোনো কক্ষেই শিক্ষার্থীদের বসার জন্য বেঞ্চ নেই। তাই তারা মেঝেতে চটাই পেতে বসে পাঠ গ্রহণ করছে। ফ্যান নেই কোনো কক্ষেই। শিক্ষকদের বসার জন্য রয়েছে ছোট্ট একটি অফিস কক্ষ। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ক্লান্তি নেই কারো মধ্যে। শিক্ষক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। শিশু শিক্ষার্থীও তা গ্রহণ করছে আনন্দের সঙ্গে। তবে উপবৃত্তি ও বিস্কুট না দেওয়ায় কিছুটা কষ্ট রয়েছে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর। বর্তমানে রয়েছে চারটি শ্রেণি। নার্সারি, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি। শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন। নিয়মিত পাঠ্যবইয়ের বাইরেও কম্পিউটার ও গানের ক্লাস হয় প্রতিসপ্তাহে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য রয়েছে আলাদা শিক্ষক। গণিত ও ইংরেজির জন্য জাহানারা বেগম, বাংলা-সমাজ ও নৈতিক শিক্ষার ক্লাস নেন সুফিয়া বেগম, তানিয়া আক্তার নেন গানের ক্লাস, আইসিটির জন্য জারমিনা এবং বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নেন আন্নাহার। বলা চলে, শিক্ষকরা বিনা পারিশ্রমিকেই পাঠ দিচ্ছেন বাংলা স্কুলে। কারণ, মাস শেষে তাদের হাতে যা তুলে দেওয়া হয় তা একেবারেই নগণ্য।

কথা হয় শিক্ষার্থী নাবার সঙ্গে। সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সে জানায়, ওই স্কুলে সে নিয়মিত আসে। সে এখানে পড়তে পেরে বেশ খুশি। একই শ্রেণির শিক্ষার্থী লিজা জানায়, তাদের পাঠ নিতে কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, তাদের শিক্ষক আপারা এত ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন যে, তাদের পাঠ বুঝতে কোনো কষ্ট হয় না। দ্বিতীয় শ্রেণির সোয়াদ, প্রথম শ্রেণির সপ্তমিসহ একাধিক শিক্ষার্থী বেশ আনন্দের সঙ্গে তাদের ভালো লাগার কথা জানান। অভিভাবকরাও বাংলা স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে আশাবাদী। কথা হয় লাকি বেগম নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি জানান, তার ছেলে ওই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পার্শ্ববর্তী অন্য স্কুলের চেয়েও বাংলা স্কুলের লেখাপড়ার মান অনেক ভালো বলে ওই অভিভাবক মনে করেন।

গানের শিক্ষক তানিয়া আক্তার বলেন, আমরা বাচ্চাদের নিয়মিত পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নির্মল বিনোদন চর্চার জন্য গানের ক্লাস নিই। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন অত্যন্ত জরুরি। তবে আইসিটির শিক্ষক জারমিনা জানান, স্কুলের বেড়া ভালো না হওয়ায় স্কুলের আইসিটি ক্লাসের কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার বাসায় রাখা হয়েছে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে একদিন গিয়ে শিক্ষার্থীরা আইসিটি বিষয়ে ব্যবহারিক ক্লাস করে।

ওই বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রাশেদুল ইসলাম। বর্তমানে তার বয়স ৩৪। তিনি প্রায় দশ বছর দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশের মানুষের জীবনযাত্রা দেখে তার মনে নিজের দেশের মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন বাসা বাঁধে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলা স্কুল আমার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমার একটি ফাউন্ডেশন করার ইচ্ছে রয়েছে। দেশ ফাউন্ডেশন নামে আমি সেটা করতে চাই। তারই প্রথম পদক্ষেপ আমার এই বাংলা স্কুল। এখানে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও সচ্ছল পরিবারের শিশুরাও পড়ছে। পাশাপাশি বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তিদের জন্য অক্ষর জ্ঞানের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের ক্লাস বিকালে নেওয়া হয়। তিনি জানান, ২২ জন বয়স্ক ব্যক্তি নিয়ে ওই বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। সুফিয়া বেগম ও তানিয়া আক্তার তাদের অক্ষর জ্ঞান দিচ্ছেন নিয়মিত বিকাল বেলা।

বর্তমানে ওই স্কুলটি অস্থায়ী একখণ্ড জমিতে আছে। প্রতিষ্ঠাতা জানান, স্কুলের পাশে ৩৩ শতাংশের অধিক অন্য একটি জমিতে বাংলা স্কুল স্থানান্তর করা হবে। প্রয়োজনে তিনি আরো জমি দিতে প্রস্তুত আছেন। তখন পর্যায়ক্রমে স্কুলকে মাধ্যমিকে উন্নীত করা হবে।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আজিজুল হক বলেন, বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব। নিরক্ষরমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা স্কুল তারই উদাহরণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads